সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাহুল মজুমদার

নেশা ও পেশা

জীবনধারণের জন্য মানুষের প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র আর আবাস| এগুলি মিটলে তারপর প্রয়োজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের| কিন্তু এই সমস্তই মানুষের নিত্য প্রয়োজনগুলি মেটায়| খাদ্য ও বাসস্থান পশু পাখিরও প্রয়োজন হয়, কিন্তু যেহেতু মানুষ পশু পাখিদের থেকে বেশী সভ্য তাই তার বস্ত্রও প্রয়োজন হয়| দেহের নগ্নতাকে ঢাকার জন্য যেমন বস্ত্র প্রয়োজন তেমনি মনের পাশব বৃত্তিগুলিকে দূর করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা| আর শরীর অসুস্থ হলে তার জন্য প্রয়োজন চিকিৎসা| তাই এই সমস্ত কিছুই মানুষের মানুষের মত বাঁচার উপকরণ| কিন্তু মানুষের শুধু শরীর নেই তার মনও রয়েছে, তাই তার খোরাকেরও প্রয়োজন| কিন্তু এই খোরাক কোন বস্তু নয়, যাকে উদরস্থ করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে| মানুষ এই খোরাক পায় সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদি থেকে|

এখন সাহিত্য সংস্কৃতি মূলত দুধরেনের হয় – একটি হল বাজার চলতি এবং দ্বিতীয়টি নিখাদ আনন্দলাভের জন্য| আবার সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদির একটা বাজারও রয়েছে যেখানে এগুলি পণ্য হিসাবে বিক্রি হয়| অর্থাৎ সাহিত্য সংস্কৃতি একই সঙ্গে মনের আনন্দ এবং জীবিকা দুটিরই ব্যবস্থা করতে পারে| বহু মানুষ রয়েছেন যাঁদের কাছে এগুলি জীবিকা বা গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় আবার বহু মানুষ রয়েছেন যাঁদের কাছে এগুলি মনের বন্ধন মুক্তির উপায়| প্রথমোক্ত দলের কাছে এটি একটি পেশা এবং শেষোক্ত দলের কাছে এটি নেশা| তবে সমস্ত মানুষই যে নেশা হিসাবে শিল্প সাহিত্যকে বেছে নেন তা নয়| কেউ কেউ শখের ডাক্তার, শখের শিক্ষক হয়ে থাকেন| সাহিত্যে শখের গোয়েন্দার অভাব নেই| কিন্তু শখ করে কেউ রাজমিস্ত্রী, কৃষক বা তাঁতী হন না যদিও শখ করে বাগান করেন, কিন্তু আবার শখ করে কেউ মালির বৃত্তিও গ্রহণ করেন না|

যাইহোক এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বর্তমান নিবন্ধে সেই বিষয়গুলিকে আলোচনার মধ্যে রাখা হয়েহে যেগুলি একই সঙ্গে একজন মানুষের নেশা ও পেশা হতে পারে| নিছক নেশা যেমন মদ্যপান, ধুমপান, পান খাওয়া বা জুয়াখেলা ইত্যাদি এই আলোচনার আওতাভুক্ত নয়|

এখানে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েহে যে সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ইত্যাদি প্রথমত মানুষের মনের খোরাক জোগায়| এর প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের আনন্দলাভ| এগুলিকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করলে তাতে হয়ত অর্থলাভ হয় ঠিকই কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য পণ্যের মত জনগনের মর্জিমাফিক এগুলির কেনাবেচা চলে| কিন্তু বস্তুগত পণ্য যেমন চাল, ডাল, তেল, নুন ইত্যাদি মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায়, এগুলি নাহলে মানুষের জীবন অচল| কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতি অপরিহার্য নয়| একটিও বই না পড়ে, একটিও গান না শুনে একটি মানুষ বহু বছর কাটিয়ে দিতে পারেন| অর্থাৎ পণ্য হিসাবে নিলে এগুলির গ্রহণযোগ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে| এছাড়াও আরো একটি সমস্যা রয়েছে| কোন বস্তুকে যত্ন করে, সতর্কতা নিয়ে তৈরী করলে সেটি সাধারণত উচ্চমানের হয়, ক্রেতারা তাকে গ্রহণ করেন, কিন্তু মানবচরিত্র অতি জটিল বিষয়, সে কি পছন্দ করে এবং কি করে না তা বোঝা প্রায় আসাধ্য| তাই অনিশ্চয়তার পরিমান আরো বেড়ে যায়|

অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকেরই প্রথমে একটা স্বতন্ত্র জীবিকা থাকে| তারপর সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবস্থান সুদৃঢ় হলে অনেকেই সেই জীবিকা ত্যাগ করে, এই ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন| আবার অনেকেই সারা জীবন তাঁর পেশাটিকে ধরে রাখেন| সাধারনত দেখা যায় কোন শিল্পী বা সাহিত্যিকের অবস্থান সুদৃঢ় হলে তিনি সেই জীবিকা ত্যাগ করেন| যে সমস্ত ব্যক্তিরা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন সাধারণত তাঁরা অন্য পেশাকে পাশাপাশি চালিয়ে যেতে পারেন না| যেমন চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রে পরিচালক বা প্রধান চরিত্রে রূপদানকারী অর্থাৎ নায়কনায়িকাদের পক্ষে স্বতন্ত্র পেশা বজায় রাখা অত্যন্ত সমস্যাসঙ্কুল, কিন্তু যারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁরা তা করতে পারেন|

শিল্প–সাহিত্য–চলচ্চিত্রকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করলে আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে| সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে সমান অর্থলাভ হয় না| এই কারণে কোন একজন অভিনেতা যদি দেখেন কোন এক বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করলে বা বিশেষ কোন প্রযোজকের ছবিতে কাজ করলে অর্থাগম বেশী হচ্ছে তাহলে সেই বিশেষ পরিচালকের ছবিতে কাজ করার জন্যে তার মধ্যে প্রবণতা আসতে পারে| আবার কোন লেখক যদি দেখেন কোন বিশেষ পত্রিকায় বা কোন একটি বিশেষ ধরণের লেখা লিখলে অর্থাগম বেশী হচ্ছে তাহলে তাঁর সৃষ্টিকর্মের পরিধি সংকুচিত হবে| কিন্তু কোন লেখক বা শিল্পী যদি শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের কথা চিন্তা না করে মনের টানে তাঁর কাজ করে যান তাহলে তাঁর প্রতিভা আরো বেশী বিস্তার লাভ করবে|

লেখকদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পেশা থাকা অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সাহিত্য কাজেও সাহায্য করতে পারে| যেমন তাঁর পেশাগত জীবনের অভিঞ্জতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে পরেন| এই প্রসঙ্গে আমরা বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন শক্তিমান লেখকের কথা উল্লেখ করতে পারি| যেমন ‘লৌহকপাট` গ্রন্থটির রচয়িতা চারুচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন জেলর, বিখ্যাত ছোটগল্পকার বনফুল ছিলেন একজন চিকিৎসক ইত্যাদি| এই সমস্ত সাহিত্যিকেরা তাঁদের কর্মজীবনে অভিঞ্জতাকে সাহিত্যে সৃষ্টির কাজে প্রয়োগ করেছেন|

যে কোন লেখক বা শিল্পী সাহিত্য বা শিল্পচর্চা শুরু করেন প্রানের টানে| তখন তার থেকে মনের আনন্দ ছাড়া তাঁর অন্য কিছু লাভ করার থাকে না| কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সেই নেশাটিকে পেশায় পরিনত করেন বা কোন বিশেষ পরিস্থিতির চাপে করতে বাধ্য হন| এই সমস্থ ক্ষেত্রে আনন্দলাভের বিষয়টি গভীর নিরানন্দের কারণ হয়ে উঠতে পারে কারণ সে ক্ষেত্রে অর্থ, খ্যাতি, ইত্যাদির মাপকাঠিতে সাফল্যেকে বিচার করা হয়ে থাকে|

তবে নেশা কে পেশা করলে অর্থাৎ শিল্পসাহিত্যকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যম করলে একটি সুবিধা রয়েছে| সেক্ষেত্রে নেশা ও পেশার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার দুঃসাধ্য কাজটি করতে হয় না| এটি নিঃসন্দেহে একটি লাভের দিক|

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বুলবুল আহমেদ

সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা, এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। --- রাম প্রসাদ সেন মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি –  মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

আবদুল হক

একজন গোবিন্দ দেব ও তাঁর নীরবতা দিবস গোবিন্দচন্দ্র দেব কেবল পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন না, জীবনযাপনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার মানুষ। নীরব ধ্যানী, নিবিষ্ট চিন্তক, নিভৃত সাধক। আমরা কেউ পুণ্যবাদী, কেউ পুঁজিবাদী। তিনি এ দুয়ের বাইরে গিয়ে, উর্ধে উঠে, হয়েছিলেন মানুষবাদী।

সত্যরঞ্জন বিশ্বাস

প্রেক্ষিত চড়কঃ মুসলিম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বর্ষশেষের উৎসব হিসাবে ‘ চড় ক ’ বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকোৎসব। গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবি মানুষেরাই চড়ক উৎসবের মূল হোতা। দরিদ্রদের এই মহোৎসবকে বসন্তোৎসব হিসাবেও গণ্য করা যায়।