সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক
মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা,
এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।
--- রাম প্রসাদ সেন
মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা
কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক
প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের
অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা,
শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে
মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে
সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়,
মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি – মানুষ নিজেকে
খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে
‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ
বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির,
উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ঢাকার
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং ‘শিখা’ ছিলো তাদের মনন চর্চার বার্ষিক
মুখপত্র। তাঁরা যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মকে বিচার ও
শোধন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের চিন্তার গড়নে ছিলো অধ্যায়নের স্পর্শ, প্রকাশের প্রধান
মাধ্যম ছিলো প্রবন্ধ আর বক্তব্যে ছিল তুলনামূলক বিচারবোধ। নিজস্ব ভাবনাকে মূল্য
দিতে তাঁরা উৎসুক ছিলেন, ব্যাক্তির অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠায় তাঁরা ছিলেন তৎপর।
নানাবিধ সংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল চিন্তাচর্চায় ‘শিখাগোষ্ঠি’র
দারুণ অবদান রয়েছে। তাদের আন্দোলনের কথা ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। আর মোতাহার
হোসেন চৌধুরীর চর্চ্চার কেন্দ্রে রয়েছে সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতির সাধনাকেই তিনি
মনুষ্যত্বের সাধনা বলে মনে করেছেন। সভ্যতা-সংস্কৃতি-সৌন্দর্যানুভুতি বিষয়ে তিনি মত
ব্যক্ত করেছেন স্থির প্রত্যয়ে। তার প্রবন্ধ সংকলনের নাম প্রবন্ধের সুচনা-বাক্য – ‘ধর্ম
সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম – একরকম প্রবচনের
মর্যাদা লাভ করেছে। মোতাহের হোসেনের জন্ম বাংলাদেশের নোয়াখালিতে। পড়াশনা করেছেন
কুমিল্লায় ও ঢাকায়। তিনি একসময় কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন এবং
দেশভাগের পর চট্টগ্রামে চলে যান।
সংস্কৃতিই এক অর্থে জীবন।
যেখানে উন্নত সংস্কৃতি সেখানেই উন্নত জীবন বলে মোতায়ের হোসেন মনে করতেন। তাঁর
কথায়, ‘কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে
অবহিতি’। আর সংস্কৃতির আসল উদ্দেশ্য অন্তরের মধ্যে একটি ব্যক্তিগত জীবন দর্শন
সৃষ্টি করা। যিনি তা করতে পারেন তিনিই প্রকৃত অর্থে সংস্কৃতিবান। ব্যক্তির মধ্যে
থাকে যে ‘আমি’ তাকে সুন্দর করে নির্মানই সংস্কৃতির কাজ। তার মার্জিত রুচি অন্যায় ও
নিষ্ঠুরতাকে ঘৃণা করতে শেখায়। সংস্কৃতি মোতাহের হোসেনের কাছে সমাজতান্ত্রিক নয়,
একান্তই ব্যক্তিতান্ত্রিক। তাঁর মতে, ‘নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান কর, সুন্দর করো,
বিচিত্র করো এ-ই কালচারের আদেশ’। সংস্কৃতি মানুষ স্বতন্ত্র হয়েও সামাজিক। তিনি
সমাজের দিকে তাকিয়ে সমাজের প্রয়োজনে নিজেকে সৃষ্টি করেন না, সৃষ্টি করেন নিজের
দিকে তাকিয়ে নিজেরই প্রয়োজনে। তিনি বলেছেন, ‘অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও
প্রমান-সাইজ করে রাখে, মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশ : দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না। এগারোদের সে সহ্য করে না –
যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কালচারের আদেশ : দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো
করে, সর্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে সমাজের সেবা, যদিও সমাজের
বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য’।
ব্যক্তিত্বের সাধনা সংস্কৃতির
সাধনার মূল ভাবনা। সংস্কৃতিবান মানুষ সেকারনে কোন ‘ইজম’ বা মতবাদে আবদ্ধ থাকতে
পারেন না। মতবাদে আবদ্ধ থাকা মানে নিজের চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা। চিন্তা ও
বিশ্বাসের সমতা বিধান করতে গিয়ে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য লুপ্ত করে বলে রাজনীতির মত
ধর্মও অনেক সময় সংস্কৃতির পরিপন্থি হয়ে দাঁড়ায়। ধার্মিক মানুষ ধর্ম পালন করেন ভয়ে
আর পুরস্কারের লোভে। কিন্তু সংস্কৃতিবান চালিত হন ভালোবাসার তাগিদে। কাউকে তুষ্ট
করার দায় থাকে না তার। এ প্রসঙ্গে মোতাহের হোসেন বলেছেন, ‘সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত
কালচারের উদ্দেশ্য নয় – উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি
করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অবিধা পেতেপারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্মকে যে
গ্রহণ করে তারা আল্লাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ’র
উক্তি : Beware of the man whose
God is in the skies – আল্লা
যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে-কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ
হতে পারে। আল্লাকে স্বরণ করে সে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার জন্য আর পরকালে
দোজকের আজাব থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণির সিট
রিজার্ভ করার অগ্রহে – অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহকালে ও পরকালে সর্বত্রই একটা
ইতর লোভ’।
ধর্ম ও রাজনীতি সব দেশেই
অনুকরণ করতে শেখায়, অনুসরণ করার কথা বলে না, বলে না ব্যক্তির কোনো উত্তরণের কথা।
মতবাদীও একই দোষে দোষী। ধার্মিকের সাথে তার একটা সাদৃশ্য দেখা যায়। উভয়েই সরকারি ও
দরকারি গলায় কথা বলে ব্যক্তির বৈশিষ্ঠ্যের উপরে স্টীমরোলার চালাতে ভালোবাসে।
ধর্মের মত মতবাদও মনের জগতে লেফট-রাইট করতে শেখায়। তাদের জীবন নিয়ন্ত্রন করে ভয় ও
লোভ। সংস্কৃতিবান মানুষের ও-সবের বালাই নেই। আনন্দই তার পুরস্কার। আর নিজের
স্বর্গটি সে নিজেই সৃষ্টি করে নেয়। দূরের স্বর্গের জন্য তাকে তাকিয়ে থাকতে হয় না।
মোতাহের হোসেনের মতে, ‘সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রন – নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা’।
তবে তা নীতিবাগিশদের আত্মনির্যাতন নয়। সমাজ বা রাষ্ট্র ও তার আইন-কানুন, ধর্ম ও
বিধি-বিধান এসবকে মোতাহের হোসেন মানুষের সামগ্রিক বিকাশের অন্তরায় বিবেচনা করেছেন।
তিনি বিবাহ নামক একটি পবিত্র-বলে-বিবেচিত প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করতেও দ্বিধা
করেননি – ‘বিবাহিত নর-নারীর প্রেমহীন স্থূল যৌন সম্ভোগে সমাজের আপত্তি নেই, কিন্তু
অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকা যদি একটু হাতে হাত রাখে, অথবা ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকায় তবেই যত
আপত্তি। প্রীতিকে বড় করে না দেখে নীতিকে বড় করে দেখার এই স্থুল পরিনতি। বলা হবে,
সমাজকে রক্ষা করতে হলে স্থূলতার প্রয়োজন আছে, অতএব তা দোষাবহ নয়। উত্তরে বলব : হ্যাঁ, সমাজের কাজ তো ঐ পর্যন্ত, নিজের কাঠামোটুকু টিকিয়ে
রাখাই তার কাজ, তার বেশি কিছু নয়। ব্যক্তির বিকাশের কথা সে যতটুকু ভাবে, তার চেয়ে
অনেক বেশি ভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কথা, আর সমাজকে টিকিয়ে রাখা মানে সমাজের
মোড়লদের টিকিয়ে রাখা – তাদের স্বার্থকে অক্ষত রাখা। ...... সমাজ মানুষের বৃদ্ধি
চায় না, চায় একটা ছাঁচের মধ্যে ফেলে তাকে কোনো প্রকারে টিকিয়ে রাখতে – তার চুড়ান্ত
বৃদ্ধিতে বাধা দিতে’। আমরা জানি সমাজ বা রাষ্ট্র দলছুটদের বা খাপ ছাড়াদের ভীষণ ভয়
পায়।
‘ব্যক্তি ও রাষ্ট্র’ প্রবন্ধে
মোতাহের হোসেনের মত, রাষ্ট্র হলো সমাজের দেহ আর ব্যক্তি হলো তার আত্মা। আর কিছু
সংখ্যক ব্যক্তি যারা সৃষ্টিশীল এবং ‘যারা প্রতিভা ও সাধনার বলে নিজেদের
সুমানসিকতার প্রতীক করে তুলতে পেরেছেন’। তিনি সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে সমাজ বা রাষ্ট্রের
উর্দ্ধে ব্যক্তির ভুমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কাজ যেখানে ফুরোয়
ব্যক্তির কাজ সেখানে শুরু হয়। ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের তাগিদে আবদ্ধ না থেকে সুমানস
সৃষ্টিকে জীবনের লক্ষ্য করে তোলে তবেই সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে, নইলে নয়। কোনো
প্রকার রাষ্ট্রে – সে গণতন্ত্রই হোক আর সমাজতন্ত্রই হোক – সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে
না। তা মানুষের আকাঙ্খার অপেক্ষা রাখে, যান্ত্রিক উপায়ে তৈরি হয় না। সুমানস
সৃষ্টির আকাঙ্খা থেকেই সভ্যতার সৃষ্টি’। তবে লেখক একটি সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে
সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন স্বীকার করেছেন। সমাজতন্ত্র ‘ক্ষুৎপিপাসার সমস্যাটির সমাধান
করে দিয়ে মানুষকে অপ্রয়োজনের জগতে’ নিয়ে যেতে পারে, তাকে সৌন্দর্য ও
আনন্দ-সম্ভোগের সুযোগ করে দেয়, তার সৃজনশীলতার পথকে সুগম করতে পারে। আর আমরা তো
জানি মানুষের শিল্পসৃষ্টির মূলে প্রয়োজনের তাগাদা থাকে না। সামাজিক সত্য ও
ব্যক্তিক সত্য এক হতে পারে না। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে সাম্যকামনা ব্যক্তির মৃত্যু
কামনারই সামিল। তিনি বড় সুন্দর করে বলেছেন : ‘সমাজতন্ত্র না হলে মানুষ
বাঁচে না; ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য না থাকলে মনুষত্ব মরে যায়’।
ধর্মীয় কিংবা জাতীয় অহমিকা বা
শ্রেষ্ঠত্ববোধকে মোতাহের হোসেন মনুষ্যত্ব বিকাশের
পরিপন্থী বলে মনে করেছেন। তিনি লিখেছেন : ধর্মীয় অহমিকা বা জাতীয়
অহমিকার তাগিদে যত কুকাণ্ড হয়েছে, ব্যক্তিগত কি পারিবারিক অহমিকার তাগিদে তার
শতাংশের একাংশও হয় নি। আমরা যখন প্রমান করতে লেগে যাই, ইসলাম জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্ম
আর হজরত মহম্মদ জগতের শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ, তখন তা অহমিকার তাগিদেই করি, মনুষ্যত্বের
তাগিদে করি নে’। যে-কোনো সময়ের প্রেক্ষিতেই অত্যন্ত সাহসী মন্তব্য।
লেখকের ধারণা, প্রকৃত
সংস্কৃতিবান ব্যক্তি কখনোই কোনো মতবাদের অন্ধ অনুকারী হতে পারেন না। মতবাদ
ব্যাপারটা বাইরের জিনিস, আর সংস্কৃতিকামীর উদ্দেশ্য হলো, ‘বহু বেদনায় নিজের ভিতর
থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া’। ধার্মিকের মতো মতবাদীরও গোঁড়ামির উৎসে কাজ করে
আপন মতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অসংশয় ধারণা। তাই তিনি লিখেছেন, ‘আইডিয়ার গোঁড়ামির
থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটু
খানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই
সংস্কৃতির লক্ষ্য’।
যে-কোনো মতবাদের ঊর্ধ্বে
মনুষ্যত্বের সাধনাকে স্থান দেওয়া প্রয়োজন। সামাজিক-রাষ্ট্রিক সংকট মোচনে মোতাহের
হোসেন চৌধুরী মানুষের শুভবোধের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদেরকে প্রতিবেশির
কাছে যেতে হবে ‘রাজনীতি বা ধর্মের নামে নয়, মনুষ্যত্বের নামে’। কেননা, তিনি
দেখেছেন, ‘এই দুই নামে মানুষ সংকীর্ন ও ক্ষুদ্রমনা হয়ে পড়ে, মানুষের ভেতরের মহান
প্রেরণা নষ্ট হয়ে যায়’। এ প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য আমাদের নাড়া দেয় খুব : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শুধু মানুষ মারা যায় বলে যে দুঃখ তা
নয়, যারা মারতে আসে তাদের মনুষ্যত্ব মরে যাওয়ার দুঃখও অপরিসীম। অবশ্য মনুষ্যত্বের
মৃত্যুর কোন পরিসংখ্যান হয় না বা সাংবাদিক সম্মেলন করে তার ছবি দেখান সম্ভব হয় না।
সমাজে দাঙ্গা বাধাবার পিছনে শাসক শ্রেণি বা কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের ভূমিকাকে
তিনি শনাক্ত করে মন্তব্য করেছেন, ‘শাসকশ্রেণী অনেক সময় create enemy and rule – শ্ত্রু সৃষ্টি করে শাসন কর – এই নীতির
অনুসরণে শাসনের পথ মসৃণ করতে চান। কিন্তু তাঁদের সে-চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে
না-পারলে মানুষের মুক্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে – মানুষ যে তিমিরে সে-তিমিরেই থেকে যায়’।
আর একজন সহৃদয় সমাজ বিজ্ঞানীর মতো তিনিও লক্ষ্য করেছেন পৃথিবীর প্রায় সব
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক বা একাধিক অর্থনৈতিক দিক থাকে। এপ্রঙ্গেই কারণটিকে শনাক্ত
করে তিনি লেখেন : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে একটা বাইরের ক্ষত
মনে করা হলে ভুল করা হবে। সমাজদেহের গভীরে যে ব্যাধির বীজ গুপ্ত রয়েছে, এ তারই
বহিঃপ্রকাশ। তাই রোগের মূল কারণকে উৎপাটন করার চেষ্টা না করে শুধু বাইরে প্রলেপ
লাগালে স্থায়ী ফল পাওয়ার আশা কম। অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলায় মানুষ আজ বিভ্রান্ত।
মানুষের সেই বিভ্রান্তিই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। তাকে
একটা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার মনে করলে অন্যায় করা হবে। অর্থনৈতিক নৈরাশ্য দূর করে সুস্থ
ও সুখি সমাজ গড়ে তুলতে না পারলে এই দূর্মর ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন’।
আর এই মানুষকে ‘ক্ষুৎপিপাসার অত্যাচার থেকে মুক্তি’ দিতে না-পারলে, তার জন্য
শিক্ষার ব্যবস্থা না করা গেলে, কেবল নীতিবাক্য বা শাসনের দ্বারা সে-ইপ্সিত মানসিক
রূপান্তর আনা সম্ভব নয়।
সংস্কৃতির চর্চার মধ্য দিয়ে
মানুষের ভিতরের এই পশু প্রবৃত্তির অবসান ও তাকে মনুষ্যত্বলোকে উন্নীত করার কথা
মোতাহের হোসেন বলেছেন বারবার। তাঁর মতে সংস্কৃতি মানে জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে
ধারণা। ‘সংস্কার মুক্তি ছাড়াও সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ ছাড়া সংস্কৃতি
অসম্ভব’। এপ্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের সারাৎসার আমরা পেয়েছি : ‘সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মত করে বলতে গেলে, সংস্কৃতি
মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎ ভাবে বাঁচা; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের
মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা; কাব্যপাঠের
মারফতে ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা; আকাশের নিলিমায়, তৃণগুল্মের
শ্যমলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা; গল্পকাহিনীর মারফতে,
নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা; ভ্রমন কাহিনীর মারফতে বিচিত্র-দেশ ও বিচিত্র
জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গি হয়ে বাঁচা; ইতিহাসের মারফতে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা;
জীবন-কাহিনীর মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গিকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা।
প্রচুরভাবে বাঁচা, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা’।
লেখক ‘প্রচুরভাবে’ বাঁচার কথা
বলেছেন, ‘প্রবলভাবে’ নয়। তাঁর মতে, প্রবলভাবে বাঁচা মানে আদর্শের বা মতবাদের অন্ধ
গোঁড়ামি নিয়ে, জীবনের বৈচিত্র হারিয়ে, হইচই করে বাঁচা। এই বাঁচায় আত্মার সাথে, বোধের
সাথে, মননের সাথে যোগ থাকে না। এভাবে বাঁচাকে তিনি মৃত্যুরই শামিল গন্য করেছেন।
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথায়, ‘সংস্কৃতির সাধনা বহুভঙ্গিম জীবনের সাধনা’। এক
নিঃসঙ্গ দূরত্বের শিখর থেকে তাঁর শুভ্র হৃদয় নিশানের মত তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন অনাগত
কালের মানুষের জন্য, যদি মানুষ দেখে, যদি একবার কেউ থমকে দাঁড়ায়, যদি একবার ভাবে,
যদি তার মানসের রূপান্তর ঘটে, এই আশায়।
****
এ তো রীতিমত সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা। বোঝাই যাচ্ছে প্রচুর পরিশ্রমের ফসল। অসাধারন লেখা এবং ছবিতে পূর্ণ।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা বাংলা সাহিত্য কে।
এগিয়ে চলুন, আমাদের আলোকিত করুন।
আপনার মতামত আমাদের অনুপ্রাণিত করছে। অনিবার্য কারণে কিছুদিন বিরতির পর আমরা খুব শীঘ্রই ফিরে আসছি। সংগে থাকুন, ভালো থাকুন। শুভরাত্রি।
মুছুনমোতাহার হোসেন চৌধুরি সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।খুব ভাল- সবার পড়া দরকার তার লেখা ।পরিচিত করে দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনমোতাহার হোসেন চৌধুরি সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম।খুব ভাল- সবার পড়া দরকার তার লেখা ।পরিচিত করে দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকেও। সময় দিয়ে পড়ার জন্য।ভালো থাকবেন। শুভরাত্রি।
মুছুন