বাংলা,
বাংলা নয়, বাংলা হয়
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও
সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের অনেকের আবেগই পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি,
কখনও কখনও উনিশে মে তে-ই সীমাবদ্ধ থাকে। এই সব নির্দিষ্ট দিনে আমরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে কথা বলি,
গান গাই, হয়তো তর্কও করি।
আমরা অনেকেই বাংলা
ভাষা-সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথ, আমাদের নজরুল, আমাদের
জসীমউদ্দিন ইত্যাদি প্রভৃতি খুবই আবেগদীপ্ত কণ্ঠে বলে থাকি। সেই সংগে বলি বাংলাদেশ
( একদা পূর্বপাকিস্তান, তারও আগে পূর্ববঙ্গ) ও আমাদের ভাষা ঐক্য, সংস্কৃতি বিষয়ক
সাজুজ্য ও সাহিত্য বিষয়ে মিলমিশের কথা। কিন্তু এসব বলার সময় আমরা অনেকে ভুলে যাই বা
ভুলে থাকতে চাই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, সিনেমা বা নাটক
ভাবনা কোনভাবেই এক নয়, এক হওয়া সম্ভবও নয়। এই যে সম্ভব না হওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি
কারণ আছে, তার একটি বড় কারণ অখণ্ড বঙ্গের বারো ভূঁইয়ারা – চাঁদ রায়, কেদার রায়,
প্রতাপাদিত্য, ঈশা খাঁ প্রমুখদের স্বাধীন তলোয়ার ও কামান কখনও সুদূর দিল্লির
অধীনতা – বশ্যতা স্বীকার করেনি। পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ১৯৪৭-এর ১৪ ও ১৫ই আগষ্টের
পর খণ্ডিত স্বাধীনতা উত্তর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা দেখালেন শুধুমাত্র মজহব বা
ইসলামের দোহাই দিয়ে কোন দেশকে অখণ্ড রাখা যায় না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা
ভাষা-সংস্কৃতি, জাতিসত্তা ও জাতীয়তার ওপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে তাঁরা
বিদ্রোহ করলেন। এরই ফলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারি।
ফলে সভা-সমাবেশ, সেমিনার,
মিটিং মিছিলে যতই আমরা আবেগতাড়িত কণ্ঠে দুই বাংলার আকাশ, বাতাস,
ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এক ও অভিন্ন বলিনা কেন, সেই উচ্চারণে সারবত্তা, সত্যতার
তুলনায় আবেগ অনেক অনেক বেশি।
মনে রাখতে হবে, একদা পূর্ব
পাকিস্তান, পরে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বারবার ফৌজি উর্দির আধিপত্য সেনা
ব্যারাক থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে শাসন ক্ষমতা দখল করেছে। কণ্ঠ রোধ করেছে গণতন্ত্রের।
‘বেসিক ডেমোক্রেসি’র নামে স্বৈরাচারী ফৌজি নায়ক আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানদের বিরুদ্ধে খাড়া করতে চেয়েছেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। যেখানে ভারতের
সহযোগীতা নিয়ে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীকে উৎখাতের মিথ্যা অভিযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর
বিরুদ্ধে। থাক সেসব প্রসঙ্গ।
বার বার ফৌজি শাসন,
গনতন্ত্রের সুষ্টু বিকাশে বাধা বাংলাদেশের সাহিত্যকে অন্য রকম স্রোতে চলতে বাদ্ধ্য
কররেছে। ফলে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
থেকে শুরু করে শাহীদুল জাহির, মনিরা কায়েস, সালমা বাণী, অদিতি ফাল্গুনী, প্রশান্ত
মৃধা, কমল সামিন, শামীমূল হক শামীম, মনজুরুল ইসলাম, আবু হাসান শাহরিয়ার, শামীম
রেজা সহ অনেকের লেখাই একেবারে অন্য রকম। সেই অন্যরকমটা যে কী তা সবিস্তারে বলতে
গেলে অনেকটা জায়গা দরকার। ফলে বিস্তারে যাচ্ছি না। কিন্তু যেটুকু বলার, তা হল
বাংলাদেশের প্রকৃতি ক্রমাগত আগ্রাসন সত্ত্বেও ভারতের তুলনায় খানিকটা অটুট। যেহেতু
বাংলাই একমাত্র ভাষা, তাই চাকরি বা উচ্চপদস্ত হওয়ার জন্য ইংরাজির হাতছানি থাকলেও,
বাংলা ভাষা কাজের ভাষা, অফিষ আদালতের ভাষা হিষাবে তার গুরুত্ব হারায় নি। ফলে এই
সবের ছায়াপাত ভাষা-সাহিত্য নির্মানে হয়েছে।
আমরা জানি দশ-বারো মেইল অন্তর
অন্তর বদলে যায় ভাষা। পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে যেমন
এই ব্যপারটা সত্যি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে চট্টগ্রাম সিলেট (শ্রীহট্ট),
নোয়াখালি, বরিশাল, ফরিদপুর, পাবনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, যশোহর ও খুলনার
মুখের ভাষা স্বাভাবিক কারণেই একে অন্যের থেকে অনেকখানি দুরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল।
পশ্চিমবাংলাতেও হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া,
মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুরের ভাষা এক নয়। যদিও বাঁকুড়ার নিজস্ব ভাষা বাঁকড়ি
অন্য অনেক অনেক পরিসরে ছোট ভাষার মতই লুপ্তপ্রায়। টিভির দৌলতে মুর্শিদাবাদ,
পুরুলিয়ার ভাষার স্বাতন্ত্রও অস্তগামী।
ভারতীয় নগরায়ণের তুলনায়
বাংলাদেশি নগরায়ণের গতি স্বাভাবিকভাবেই খানিকটা শ্লথ। যদিও বাংলাদেশের নদী,
পশ্চিমবাংলাতে যেমন হচ্ছে, সেভাবেই ‘চুরি’যাচ্ছে অনবরত। ঢাকার কাছে ‘তুরাগ’নামের
জলধারাটি অদৃশ্যপ্রায়, ২০১০ এ শেষবার বাংলাদেশে গিয়ে তেমনই দেখেছি। পশ্চিম বাংলায়
সোনাই, মরালী, সরস্বতী সহ একাধিক নদি চুরি গেছে। ইছামতি, যমুনার অবস্থাও ভালো নয়।
এই অবস্থা ‘ভালো নয়’এর তালিকায় আরও বহু জলধারা আছে। তারা ক্রমক্ষীয়মাণ। তবু
পশ্চিমবাংলার তুলনায় প্রকৃতির অটুট থাকা, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবনা চিন্তায়
পার্থক্য বাংলাদেশকে তার সাহিত্য-শিল্প তৈরীর ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। এই
ফারাক খুবই স্বাভাবিক।
ফলে বাংলাদেশে একাত্তরের
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন তৈরি হয়। ফেসবুক টুইটারের
দৌলতে তার খবর ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল
হয় ঢাকা সমেত সমস্ত বাংলাদেশ। ঢাকায় তৈরি হয় প্রতিবাদ মঞ্চ। শেষ পর্যন্ত এই উত্তাল
আন্দোলনের স্থায়িত্ব না থাকার পেছনে আমার মনে হয় শুধুমাত্র ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ
ইত্যাদি প্রভৃতিতে এইধরনের আন্দোলনের স্থায়িত্ব দেওয়া প্রায় আসম্ভব। যদিও মিশরে
স্বৈরাচারী শাসনের পতনের দাবিতে ঘটে যাওয়া গোলাপি বিপ্লবের পিছনেও ছিল সোসাল
মিডিয়ার বিপুল প্রভাব। সেই সঙ্গে সঙ্গে হয়তো বা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ-
এর পরোক্ষ মদত। সব মিলিয়ে ‘পিঙ্ক রেভেলিউশন’। মিশরের সেই বিপ্লব দীর্ঘজীবি হয়নি।
মিশরের ‘পিঙ্ক রেভেলিউশন’এর দশা না হলেও শাহবাগের আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে
পড়েছে। হয়তো বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদ বিরোধী গণ আন্দোলনে, একাত্তরের যুদ্ধ অপরাধী
ও রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে যে গণ অভ্যুত্থান বিপুল ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল,
গণতান্ত্রিক মানুষের সমাবেশে এক সময় সংহত হয়েছে, বিদ্রোহে বিস্ফোরণের চেহারা নিয়ে
ফেটে পড়েছে, তা আবারও নতুন কোনো তরঙ্গ হয়ে ওঠার প্রতিক্ষায় রয়েছে যে কোনো ছুতোয়,
যে কোন জায়গায়, যে কোনো মুহূর্তে তা আবারও জেগে উঠবে।
বিষয় ভাবনায় নতুনত্ব আছে। তবে ভিন্নতার স্বরূপ স্পষ্ট হতে হলে বিশদ বিশ্লেষণ জরুরি।
উত্তরমুছুন