ভাগ্য : মুসলিম
মনস্তত্ত্ব, ধর্মদর্শন ও প্রগতি
কপালের লেখন খণ্ডায় কার সাধ্য? জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কিংবা লেখাপড়া জানা-নাজানা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের সিংহভাগই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই কথাটা মেনে নেয়। জীবনের উত্থান-পতনের ইতিহাসে কপালের লেখনকে জায়গা করে দিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। বরং বলা ভালো এব্যাপারে তারা অতিমাত্রায় উদার। মানুষের মনস্তত্বের এ-এক জটিল স্তর বিন্যাস। একই মানুষ বিভিন্ন সময়ে একই বিষয়ের বিচার বিশ্লেষণে ভিন্নভিন্ন দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে। এ রকমই একটি দৃষ্টিকোণ হলো কপাল বা ভাগ্যের ভূমিকাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে ভাবা। কখনও সে ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আবার কখনও নিজেই ভাগ্যের কাছে নির্দিধায় আত্ম সমর্পন করে। নিজের ব্যার্থতার পিছনে ভাগ্যের অদৃশ্য হাতের কারসাজির কল্পনা করে নিজের ব্যার্থতাকে ঢাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে।
মজার কথা, এক্ষেত্রে মুসলিম মানসের মনস্তত্ত্ব কখনও চেতনমনে আবার কখনও অবচেতন মনে উপরওয়ালাকে (আল্লাহকে) কাঠ গড়ায় তোলে বিনা দ্বিধায়। নির্দিধায় বলে দেয়, উপরওয়ালা রাজি না থাকলে কিছুই করার থাকেনা। সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা সবই তাঁর (আল্লার) হাতে। বিশ্লেষণের ধরণটা এমন হয়, যে এক ঢিলে দুই নয়, তিন পাখি শিকার করে ফেলে তারা। এক) ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান বলে মেনে নেয়। এবং তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করলাম - এটা ভাবতে পেরে নিজেকে সাচ্ছা ধার্মিক হিসাবে গণ্য হওয়াজনিত আত্মতৃপ্তি লাভ করে, দুই) নিজের ব্যর্থতার দায় সর্বংসহা আল্লাহ-এর ঘাড়ে চাপিয়ে ভার-মুক্ত হয়ে যায়। তিন) সর্বশক্তিমান মানা ও আত্মসমর্পণ করার বার্তার মাধ্যমে ভবিষ্যতে ঈস্বরের কৃপালাভের রাস্তাকে খানিকটা হলেও খুলে গেল - এই ভাবনায় মনের জোর খানিকটা বাড়িয়ে নেয়।
আসলে মানুষ জগৎ ও জীবনের সীমাহীন রহস্যের অনেককিছুই এখনও উৎঘাটন করতে পারেনি। ভবিষ্যতে মানুষ কতটা এগোবে, তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। যে গতিতে বিজ্ঞান এগোচ্ছে, কোথায় গিয়ে মানুষ থামবে, বলা মুশকিল। কিন্তু একথা বলা মুশকিল নয় যে, জগতের সব রহস্যের ভিত্তিভূমি হল কার্যকারণ সম্পর্ক। কারণ, কারণ ছাড়া কোন কিছুই ঘটে না। আমার জীবনে যা-ই ঘটুক, তার এক বা একাধিক নির্দিষ্ট কারণ অবশ্যই থাকবে। সেই কারণের হদিশ যতদিন মানুষ পায় না, ততদিন সে কারণ হিসাবে অলৌকিক শক্তির ভূমিকাকে কল্পনা করে। এক্ষেত্রে ভাগ্যটাই কারণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়।
কিন্তু ভাগ্যকে কারণ হিসাবে দাড় করানোটা যুক্তিবিজ্ঞান মানে না। যুক্তি-বিজ্ঞানের কাছে এটা একটা হাস্যকর প্রচেষ্টা মাত্র। আসলে মানুষ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কার্যক্রমকে ভাগ্য বলে মনে করে। যেদিন ওই নিয়ন্ত্রনকারীকে মানুষ জেনে ফেলে এবং তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রন কায়েম করতে সক্ষম হয়, তখন তা আর তার কাছে ভাগ্যের বিষয় বলে বিবেচিত হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে ভাবনার এই দৈন্যতার প্রকাশ একটা সাধারণ বিষয়। চেতন কিংবা অবচেতন মনে অধিকাংশ মানুষ এভাবেই ভাবাতে অভ্যস্ত যুগ যুগ ধরে।
যারা ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হিসাবে আল্লাহকে উপস্থাপন করে, তাদের কাছে এই যুক্তির অবতারনা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ আল কোরান ভাগ্যের উপর নির্ভরতাকে স্বীকার করে না। সুরা ‘আশ শামস’এর বক্তব্যকে ব্যখ্যা করলে দেখা যায়, আল্লাহ মানুষকে দেহ, ইন্দ্রিয় ও মানসশক্তি সম্পন্ন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অসহায়ভাবে পৃথিবীতে ছেড়ে দেন নি। সেই সঙ্গে দিয়েছেন এক সহজাত (ইলহামী) জ্ঞান। যারা দ্বারা তার অবচেতন মন পাপপূন্যের পার্থক্য, ভালোমন্দের তারতম্য ও বিভিন্ন অনুভূতির পার্থক্য ধরতে পারে। এই সব পার্থক্যবোধ, ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের শক্তি, তিনি দান করেছেন, সেগুলোকে ব্যবহার করে মানুষ ভালো ও মন্দ প্রবনতাগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কোন প্রবণতাকে মানুষ বলবান করবে আর কোনটিকে দমন করবে তার উপর তার ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ নির্ভর করে। সুরা ‘আশ শামস’-এর ৮নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ফা আল হামাহা ফুজুরাহা অ তাকউয়াহা। অর্থাৎ অতঃপর তাকে (মানুষকে) তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান (সহজাত / ইলহামি জ্ঞান) দান করেছেন। ৯নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ক্বাদ আফলাহা মান যাক্কাহা’। অর্থাৎ যে নিজেকে (ঐ জ্ঞান দ্বারা) শুদ্ধ করে, সে সফল হয়। ১০নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অক্বাদ খাবা মান দাসসাহা’। অর্থাৎ এবং যে নিজেকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়। লক্ষ্যনীয়, ১৫নং আয়াতে আল্লাহ-এর তরফে স্পষ্ট করে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘অলা ইয়াখাফু উক্ববাহা’। অর্থাৎ আল্লাহ মানুষের এইরূপ ধ্বংসাত্মক পরিণতির কোন বিরূপ পরিনতির আশঙ্ক্ষা করেন না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, (ধর্মশাস্ত্র অনুসারেও) মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতায় আল্লাহ কোন অন্যায্য নিয়ন্ত্রন রাখেন না। তাই ভাগ্য নয়, কর্মই মানুষের উত্থান-পতনের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রন করে। সে-কর্ম যদি একক প্রচেষ্টার পরিণতি হয়, তবে তার দায় একান্তই নিজের ঘাড়ে বর্তায়। আর যদি তা যৌথ প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করে, তবে তা ঐ গ্রুপের যেকোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের যেকোন ভুল কিম্বা অন্যায় আচরনের কারণে ঘটতে পারে। আমি যখন পথ হাঁটি, তখন আমার পথ নিরাপত্তার বিষয়টি শুধুমাত্র আমার সচেতনার উপর নির্ভর করেনা। আমি একশো ভাগ সতর্ক থাকা সত্ত্বেও একজন গাড়ি চালকের ভুলের কারণেও আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এটাকে কখনই ভাগ্য বলা যায় না। কারণ পথ-নিরাপত্তা নামক কার্যটি যৌথ প্রচেষ্টার ফসল।
মুসলিম জনমানস ধর্মীয় মনস্তত্ত্বের নিরিখে তিনটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে আছে। ১) ধর্মপ্রাণ, ২) ধর্মজীবি, ৩) ধর্মবিমুখ। ধর্মপ্রাণ মুসলিম হল সেই শ্রেণির মুসলিম যারা মানসিকভাবে সৎ এবং ধর্মের ভালোমন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণে কখনই নিজেকে নিমগ্ন রাখে না। ধর্মের যে-দিকগুলি ভালো বলে তার কাছে মনে হয়, সে-বিষয়েই শুধু মনোনিবেশ করে; আচার আচরণে এক’শ শতাংশ সৎ ও নিষ্ঠাবান ধার্মিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য পারলৌকিক জীবনে সুখ-শান্তি লাভ করা।
ধর্মজীবি মুসলিম যারা, তারা ধর্মপালনের বিষয়ে দুটি হিসেব মাথায় রাখে। একটি ইহলৌকিক, অন্যটি পারলৌকিক। জীবন-জীবিকার জন্য এরা ধর্মকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজে লাগায়। আর অন্য মানুষকে নিজ ধর্মের অনুসারি করে তোলার চেষ্টা করে বাড়তি লাভের (ছোওয়াবের) আশায়। অনেকেই ধর্মকে জীবিকার মাধ্যম হিসাবে নির্দিধায় ব্যবহার করে। অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের সাথে সাথে আল্লাহ-এর নৈকট্যলাভের কাজে এরা ধর্মকে অবলীলায় কাজে লাগায়।
অন্যদিকে, যারা ধর্মবিমুখ মুসলিম তারা ধর্মকে ইহলৌকিক কিংবা পারলৌকিক কোনকালেরই সুখ-শান্তি লাভের কাজে ব্যবহারের বিপক্ষে। ধর্মীয় অনুশাসন গ্রহনের ক্ষেত্রে বিচার-বিবেচনাকে কাজে লাগাতে তারা দ্বিধা করে না। ধর্মীয় উৎসবকে মুসলিমদের সামাজিক উৎসব হিসাবে বিবেচনা করতেই এরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
মুসলিম সমাজে এই দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষেরই সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এদের মনস্তত্ত্ব খুবই জটিল। এরাই মানুষের সাফল্য ও ব্যর্থতার পিছনে ভাগ্যের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে বেশি আগ্রহী। আবার এরাই প্রয়োজনে ধার্মিক, অতিধার্মিক এমনকি অধার্মিক হোতেও (অবশ্যই গোপনীয়তা বজায় রেখে) দ্বিধা করে না। ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাকে প্রকৃত ধর্মপালনের অবশ্য-কর্তব্য বিষয় হিসাবে ব্যাখ্যা করে। আধুনিক শিক্ষার চেয়ে দ্বিনের (ধর্ম শিক্ষা) শিক্ষাদানের দিকে এদের ঝোঁক বেশি। তাই মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠে মোক্তব ও মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসাগুলি ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের অর্থ সাহায্যে এবং কিছু কিছু মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলির অর্থানুকূল্যে চলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কেন এই সাহায্য করে তা আলাদাভাবে আলোচ্য বিষয় হতে পারে।
লক্ষ্যনীয় বিষয় হল এইসব মাদ্রাসাগুলি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার পরিবর্তে সনাতন ধর্মশিক্ষার উপর বেশি জোর দিচ্ছে। আর্থিকদিক থেকে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা এখান থেকে আরবি ভাষাটা কোনরকমে পড়তে শেখে। সঙ্গে ইসলামি ধর্মদর্শন বিষয়ে যতসামান্য, বলা ভালো অসম্পুর্ন জ্ঞান নিয়ে এরা সংসার জীবনে প্রবেশ করে। এরপর কেউ বিল বই হাতে বেরিয়ে পড়ে মাদ্রাসার নামে দান-খয়রাত তুলতে। কেউ মসজিদে মসজিদে যৎসামান্য অর্থে নেমে যায় ইমামতি করতে। বলা বাহুল্য, এই সামান্য পয়সায় তাঁর সংসার চলার কথা না। কিন্তু তবু তারা তা করে, কারণ তাদের আশা থাকে ইমামতির দৌলতে পানি-পড়া, ঝাড়-ফুক এবং তাবিজ মাদুলি বিক্রি করে আরও বাড়তি কিছু রোজগারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একোবিংশ শতকে এসেও সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের এই যদি জীবনদর্শন হয়, তবে কীভাবে এগোবে মুসলিম সমাজ! গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবতে হবে।
এভাবে চললে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার অশুভ প্রক্রিয়াকে থামানো যাবে না। আধুনিক রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি বিষয়ে অজ্ঞ মুসলিম সমাজ তাদের নাগরিক অধিকার আদায়ের বিষয়ে যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না। তাই ভাগ্য নয়, আধুনিক যুগের উপযোগী নাগরিক শিক্ষা গ্রহনের উপর জোর দেওয়া ছাড়া মুসলিম সমাজের আর কোন নির্ভরতার বিষয় নেই। আর একাজ করতে হলে মুসলিমদেরই উদ্যোগী হয়ে মহল্লায় মহল্লায় মাদ্রাসা গজিয়ে ওঠার প্রবণতাকে রুখতে হবে এবং চলতি মাদ্রাসাগুলিকে হয় বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাদেরকে আধুনিক শিক্ষালয়ের রীতিনীতি ও কার্যক্রমকে আত্মস্থ করে নিতে হবে। মুসলিম মনস্তত্ত্বকে সুরা ‘আশ শামসে’র আলোকে আলোকিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে, এবং তা এখনি।
-----------------------
সুন্দর
উত্তরমুছুনধন্যবাদ সাথী। সময় দিয়ে পড়েছেন আমাদের কাজ। তাই আমরা খুবই খুশি। ভালো থাকবেন। শুভরাত্রি।
মুছুনপ্রবন্ধটি সুন্দরভাবে ব্বিস্তার করা হয়েছে। বেশ কয়েকবার পড়তে হবে। চমতকার ভাবে বলেছেন ধরমের দায়িত্ব নিয়ে,ধারমিকদের ধর্ম ধারন নিয়ে।
উত্তরমুছুনসত্যি সত্যি আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে ধরমের খোলসের আস্তরণ থেকে।
এই প্রসংে কোরানের এক চমৎকার চ্যাপ্টারের কথায় আসা যাক ১৩ পারা, "যে জাতি নিজের পরিবর্তন চায় না,আল্লাহ তার পরিবর্তন করেন না"
আমার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমাকেই উঠে দাড়াতে হবে ।
লেখক কে ধন্যবা।
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়া ও সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য। অনেক অনেক শুভ কামনা।
মুছুন