সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রবীর চট্টোপাধ্যায়। প্রথম পর্ব


অনার্য সংস্কৃতিকেও উদরস্থ করে গড়ে ওঠে এই ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি-

আর্যব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি যখন অনার্য সংস্কৃতি অর্থাৎ আর্য সৃষ্ট তথাকথিত শূদ্র সংস্কৃতি আত্মসাত করতে শুরু করল, তখন অনার্যদের নাগ পূজা, প্রকৃতি পূজা, চাণ্ডী পূজা, সবকিছুর মধ্যে ব্রাহ্মণ্য আচার পদ্ধতি মিশিয়ে অনার্য সংস্কৃতিকেও উদরস্থ করতে লাগল। যিনি আর্য দলপতি ও দেবতা সম্মানে মান্য হতেন, সেই ইন্দ্রকে দুই বার যুদ্ধে পরাজিত করেন যে অনার্য বীর,সেই শ্রীকৃষ্ণের হাত থেকে এই আর্যদের গুরু হিসাবে কথিত ঋষি বৃহস্পতির মধ্যস্থতায় প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে যান । সেই কৃষ্ণ'কেও দেবতা হিসেবে গ্রহন করেন আর্যব্রাহ্মণেরা।

খৃষ্ট পরবর্তী অষ্টম শতাব্দীর পর যবন আক্রমণের সময় থেকে মুসলমান রাজত্বে শ্রীকৃষ্ণাতঙ্কে সমস্ত কৃষ্ণ ও বিষ্ণু মূর্তি এবং মন্দির ধংস্বের কারণে বিষ্ণুর অংশ হিসাবে কৃষ্ণ ধ্বংসের উদ্দেশ্য, তাঁরই আরএক রূপ প্রভু জগন্নাথ, দাদা বলরাম-এর বলভদ্র রূপ ও ভগিনী শুভদ্রাকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বারেবারে পুরী মন্দির ধংস্বের জন্য আক্রমণ করে ।

এই সময় বিগ্রহ স্থানান্তরিত ও শঙ্করাচার্য কতৃক পুনরাভিষেক কেন্দ্রিক এই রথ যাত্রার প্রচলন । যা আর্যহিন্দুদের মিশ্র সংস্কৃতির আর একটি উপমা মাত্র। অন্ধ্র-প্রজাতি নুলিয়া সম্প্রদায়(কৈবর্ত অর্থাৎ অনার্য) রাজ আদেশে এই রথের রশি টানতে তাদের উড়িষ্যায় আগমন ঘটে,যেহেতু রাজাও একই সম্প্রদায় ভুক্ত ছিলেন। যে কারণে প্রাচীন এবং বড় রথযাত্রা পুরী ও মাহেশ। যেহেতু হুগলীজেলাও এক সময় উড়িষ্যা শাসনাধীন ছিল। 

মুসলমান শাসকদের এই কৃষ্ণভীতি শ্রীচৈতন্য সময়কালেও পরিলক্ষিত হয়। আমরা পৌরাণিক গ্রন্থগুলি থেকে পাই, দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক অজানা শক্তির প্রতি যে বিশ্বাস বহমান ছিল, তার সঙ্গে বহিরাগত আর্য বিশ্বাস দেবত্ববাদ সংস্কৃতি মিশ্রণের ফলে পৌত্তলিকতা পূজা আচার পদ্ধতি সৃষ্টি হয়। নবপ্রস্তর যুগের কৃষি ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত লিঙ্গ-যোনি রূপ পেল শিব-শক্তি হিসেবে। আর্যগন রূপ দিলেন নিরাকার ব্রহ্ম থেকে তিন মাথা ব্রহ্মা, হাতে বেদ, পদ্মযোনি।

শিবকে ভগবান হিসেবে মেনে নিয়ে কন্যা দান করেন দক্ষকন্যা সতীকে। সতী দেহত্যাগ করলে আবার মোঙ্গলীয় কন্যা পার্বতীর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে মিশ্র-সংস্কৃতির পাকাপাকি বন্দোবস্ত করলেন। এই মিশ্র সংস্কৃতির ফলে উদ্ভূত সংকর প্রজাতিদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হল যজ্ঞ-সংস্কৃতি ও পশুবলি এবং আচার-রীতি-নীতিকে কেন্দ্র করে ঋষিদের । নানা গোত্রের সৃষ্টি হল ঋষিদের ধরে। কার আরাধ্য কত বড় ক্ষমতা ধর, তার প্রতিযোগিতা শুরু হল ঋষিদের মধ্যে। বাড়তে লাগল বেদের স্তোত্র, ভাগ হল ঈশ্বর। সৃষ্টি হল আর এক ক্ষমতাশালী ভগবান বিষ্ণুর।

ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সৃষ্টি-স্থিতি-লয় দায়িত্ব পেলেন। আচার-রীতি-নীতি বিবর্ততিত হয়ে, যা ছিল তার থেকে নতুন হলো যজ্ঞ-বলি-সোমপান পরিত্যাগ করে শৈব হলো বৈষ্ণব। অঘোর শিব হলেন বিষ্ণু। মুক্ত যৌনাচারে জনস্ফীতির ফলে উদ্ভূত সংকর প্রজাতিদের মধ্যে আরো উপজাতি, আরও আর্য-অনার্য মিশ্রিতরক্তে নানা বর্ণ।

কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত দাস এবং পশু অর্থাৎ গো-পালক থেকে গোপ জনসংখ্যার দিক থেকে সর্বাধিক হলেও, তারাই ছিলেন সব দিক দিয়ে বঞ্চিত ও অত্যাচারিত। এই দুই জনগোষ্ঠীর পরিত্রাতা প্রতীক হিসেবে মিশ্র-সংস্কৃতি জন্ম দিল স্বয়ং বিষ্ণু অংশ হিসেবে গোপ-গোষ্ঠীপতি কৃষ্ণ ও হলধর বলরাম, যিনি আদিম লাঙ্গল থেকে লিঙ্গ বা হলধর। হরি-হর হলো একাত্মা।

এঁদের জনপ্রিয়তার গ্রাস করতেও ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় কোনো ত্রুটি রাখলেন না ।আমরা বিভিন্ন পৌরাণিক সাহিত্য থেকে জানতে পারি ঋষি নারদের কথা, জানতে পারি অনার্য শৈব ও বিষ্ণু ভক্তদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদের অকথ্য সামাজিক ও শারীরিক অত্যাচারের অলিখিত ইতিহাস ।

ঋগ্বেদ,মহাভারত থেকে সহজেই খুঁজে নেওয়া যায় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের যুদ্ধ ও বিরোধীতা।ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্যভিচার ও বিকৃতি আর্যবৈদিক ভাষার উপরেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলে একদিকে যেমন পাণিনি সংস্করিত বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ সৃষ্টি হয় সপ্তম খৃস্টপূর্বাব্দে,আবার ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে নিরীশ্বরবাদী মহাবীর জৈন-এর আবির্ভাব ঘটে।মহাবীর জৈন-এর পরম্পরাগত সম্পর্ক রয়েছে। এরপর হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধযুগ। বুদ্ধের মৃত্যুর পর ধীরেধীরে বৌদ্ধ-সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটতে লাগল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আচার-রীতি। শেষে শংকরাচার্যের হাত ধরে বিষ্ণুর দশম অবতার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সংস্করিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নবজীবন লাভ। বিপুলবেগে ধাবিত হল ভারতবর্ষের কোনায় কোনায়। এই অন্ধকার সময়কালটিকেই ঐতিহাসিকগণ নির্দিষ্ট করেছেন মধ্যযুগীয় বর্বরতার যুগ বলে। যে সংস্কার আন্দোলনের মশাল প্রজ্বলিত হয়েছিল কেরীসাহেব, রামমোহন, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালংকার, বিদ্যাসাগর-এর হাত ধরে, তার আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়ভার বর্তমান প্রজন্মের।

'ব্রাহ্মণ্যবাদ' প্রবন্ধের অংশ বিশেষ

মন্তব্যসমূহ

  1. প্রায় তিন সহস্র বছর যে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাচীনত্ব, তাকে বিস্তারিত জানতে হলে, পড়তে হবে সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি। কাজ চলছে, আশা করছি দ্রুত পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারব - -

    উত্তরমুছুন
  2. পুরোটা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। তবে অংশ বিশেষও দারুন লাগলো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বুলবুল আহমেদ

সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা, এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। --- রাম প্রসাদ সেন মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি –  মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

আবদুল হক

একজন গোবিন্দ দেব ও তাঁর নীরবতা দিবস গোবিন্দচন্দ্র দেব কেবল পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন না, জীবনযাপনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার মানুষ। নীরব ধ্যানী, নিবিষ্ট চিন্তক, নিভৃত সাধক। আমরা কেউ পুণ্যবাদী, কেউ পুঁজিবাদী। তিনি এ দুয়ের বাইরে গিয়ে, উর্ধে উঠে, হয়েছিলেন মানুষবাদী।

সত্যরঞ্জন বিশ্বাস

প্রেক্ষিত চড়কঃ মুসলিম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বর্ষশেষের উৎসব হিসাবে ‘ চড় ক ’ বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকোৎসব। গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবি মানুষেরাই চড়ক উৎসবের মূল হোতা। দরিদ্রদের এই মহোৎসবকে বসন্তোৎসব হিসাবেও গণ্য করা যায়।