সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুর্শিদ এ এম


জীবন ডাকে বারবার

একজন সুস্থ মানুষ যতদিন এই ধরার বুকে থাকে, ততদিন তার মগজে এই অনিবার্য সত্যের সন্ধান থেকে রেহাই নেই—সে কেন বেঁচে আছে? যুগে যুগে এই প্রশ্নটি যেমন সৎ মানুষকে বিব্রত ও পীড়িত করেছে, তেমনি এর সমাধানেও প্রচুর সময় ব্যয় হয়ে আছে। জীবনের সঙ্গে জন্মের যোগ অঙ্গাঙ্গি এ আর নতুন কথা কী। জন্ম আদতে এক সূক্ষ্ম অথচ জটিল প্রাকৃতিক ক্রিয়া। তবু একে ঘিরে নানা প্রশ্ন, নানা সংস্কার, নানা জল্পনা। বেঁচে থাকা এই জন্মের এক বিস্তৃত অনিবার্য রূপ। যা ক্রমশ আরেক অনিবার্যতার দিকে ধাবিত করে, যাকে আমরা সহজভাবে মৃত্যু নামে বুঝি।

এই দুই প্রাকৃতিক ক্রিয়া যাবতীয় দৃশ্যমান কিংবা কিছু অনুভূতিমান বস্তু কিংবা বস্তুগুণের প্রমাণসাপেক্ষে আমরা বুঝে থাকি। অথচ কোনো কোনো মতবাদ ইজম সংস্কার একে জটিলরূপে দেখতে বা নীরিক্ষা করতে চায়। যেমন কেউ কেউ জন্মকে আরেক বিগত জন্মের সাপেক্ষে এই ধরাধামে প্রবেশের ছাড়পত্র হিসেবে প্রতিভাত করতে চায়। তাঁদের মতবাদ মনে করে কিংবা বিশ্বাস করে, বিগত জন্মে সৎ বা অসততার সঙ্গে ইহজন্মের ভালোমন্দ জড়িত। তাহলে এক অতি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর চাওয়া যায়, বিগত জন্মের প্রমাণ কোথায়? সেটির সময়কাল বা তারিখ কোথাও প্রমাণ্য দলিল হিসেবে দাখিল করা যাবে কি না। জন্মের প্রথম বা দ্বিতীয় হয় কীভাবে?

আরেক মতবাদ মনে করে মানুষের জন্মবীজই হল অপবিত্র! যে-প্রাকৃতিক নিয়মে বংশগতি বজায় থাকে তার ধারক হল দুটি পৃথক বিপরীত সত্তা। তাকে পুরুষ ও প্রকৃতি বলা যায়। পুরুষ ও নারী বলা যায়। দুটি সত্তার পরস্পর আকুতির ফল হল জন্ম। এটি জল বাতাস অক্সিজেন সূর্যতাপ মাটি ইত্যাদির মতো সত্য। এতে পবিত্র-অপবিত্রের স্থান কীভাবে নির্ধারণ করা যাবে? পবিত্র অপবিত্র বিষয়টিও যে নিজেই খুব ঘোলাটে, একথা কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। সে-প্রসঙ্গ এখানে আলোচ্য নয়। অপবিত্র বস্তু থেকে যদি একজন মানব জন্ম নেয়, আমি যাকে এই মুহূর্তে এক মহাজাগতিক মহাপ্রাণ বলায় আপত্তি দেখি না—তাকে দিয়ে জগতের কী বা কোন কল্যাণ সাধিত হবে! কেননা, আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা স্বীকার করেছে, জগতের চলন-বলন অসীম এক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার নিমিত্তই। এবং মানবসন্তানই হল সেই মঙ্গলাঙ্ক্ষার অনবদ্য প্রতিভূ!

এই দুই বা ততোধিক মতবাদ আমাদের যেদিকে নিয়ে ফেলতে চায় তা হল, মানবজন্ম আসলে এক অনির্ধারিত, অবহেলাযোগ্য, অকিঞ্চিৎকর, হেলাফেলার বিষয়। যদি তা-ই সত্য হয়, তবে আমরা যখন সামাজিক জীব হিসেবে একজন মানুষের কর্মের মাপদণ্ড বিচার করতে যাই, তখন কীভাবে আশা করি যে, সে পার্থিব সকল কাজে সফল হবে, সকলের মঙ্গলের কথা ভাববে, জাগতিক যাবতীয় সুস্থ নিষ্ঠাবান কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে! এই কামনা সত্যি হওয়া সম্ভব নয়। এটিকে সত্যে রূপান্তরিত করবার পদ্ধতি অবশ্য দুষ্প্রাপ্য নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এই অকিঞ্চিৎকর অবস্থার সামাল দিতে আবির্ভূত করেছে মানবের হয়ে ওঠার বিশেষ এক নীতিমালাকে। যাতে তারা তাদের কৃতকর্মের সমস্তরকম কলুষ থেকে মুক্তি পেতে পারে। অর্থাৎ, যে -মতবাদ মানবকে দেগে দিচ্ছে অযাচিতরূপে, উদ্ধারকর্তারূপে আবির্ভূত হচ্ছে সে মতবাদই। একে মানবজীবনের ট্র্যাজেডি বললে কম বলা হয়। আসলে এটি জীবন পরিচালনা করবার পথে সমূহ বাধা। এই বাধাসমূহ অতিক্রম করবার নামই জীবন বা বেঁচে থাকা।

এবার আমরা ভাবতে পারি, বেঁচে কী হয়? জীবনযাপনে কী ফল মেলে? জীবন না-থাকলেই বা কী হত এমন! প্রথমেই বলা যাক, আমরা চাই বা না চাই, জীবন আছে, থাকবে। বেঁচে থাকা থাকবে। যেমন আগেই আলোচিত হয়েছে, এ এক প্রাকৃতিক নিয়ম। এর অন্যথা হবার নয়। দ্বিতীয়ত, বাঁচাই যদি অনিবার্য, তাহলে এমন দুর্দশা কেন সামনে এসে দাঁড়ায়! বেঁচে থাকাটা তো মসৃণ এক লোভনীয় বিষয় হতে পারত! জীবনযাপন এক অনবদ্য সুখের আকর হয়ে উঠতে পারত! সরল নজরে দেখলে সত্যিই মনে হয়, এভাবে মানব সমাজে যাপনের কোনো যুক্তি নেই। এক সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য, নিরুপায়তা নিয়ে চির-অসুখী এই প্রজাতি।

কিন্তু বিশেষ অবলোকনের সাহায্য নিয়ে দেখলে টের পাব, মানব-সমাজ আদতেই এক সীমাহীন সুখের স্থান। আমরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি বিশেষ চালকের দ্বারা, যাদের লক্ষ্য হল এই ধরাকে সুস্থিতি না-দেয়া। তাহলে প্রথমেই এই চালকের প্রতি আমাদের নজর না-দিয়ে উপায় নেই! এরা অনেকগুলি ভাগে বিভক্ত। গভীরভাবে দেখলে এদের স্বরূপ টের পেয়ে যাব যখন, দেখব সে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সে এই সুস্থিতির বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। হাতুড়ি যখন বড়োসড় পাথরকে ভাঙে, তখন তার কাজ হল এলোমেলো টুকরোয় সেগুলিকে গুঁড়িয়ে ফেলা। ছেনি তা করে না। সে ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম আঘাতে একটি অবয়ব নির্মাণ করতে চায়। গড়তে চায়। গড়তে চাওয়ার বিপরীতে এলোমেলো ভাঙনের সহায়ক যারা, তারাই সুস্থিতির ঘাতক শক্তি। আমরা অহরহ তাদের প্রধানত ক্ষমতাবান হিসেবে দেখি। যাকে আমরা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরূপে মানবের সেবার জন্যে তুলে ধরি ,সেই শক্তি আমাদের পিঠে ছুরি মারতে থাকে। যে নীতিমালা নৈতিকতা বিবেক আদর্শ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার অবলম্বনকে ধর্মের মোড়কে দেখতে চাই, সেই ধার্মিকতা সমাজকে নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বিপথগামী করে তোলে। যে সঞ্চয় আমাদের শ্রম, মেহনত, অবিরাম মনসংযোগ, ঐকান্তিক আগ্রহ থেকে জন্ম নেয়, তাকে যারা কুক্ষিগত করে রাখে, সেই আগ্রাসনকে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী পক্ষ বলে জানি। আমাদের লালন-পালনের সঙ্গে ,আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে যে সুর তাল লয় গুঞ্জন প্রেম ইত্যাদি আপন মহিমায় বিকশিত হয়, তাকে লুটপাট করে নিয়ে যায় কিছু বেণিয়া, ভুলিয়ে দিতে চায় আমাদের সেই ঐশর্যের কথা, কেড়ে নেয় অন্তরের যাবতীয় শুদ্ধ আবেগ—আমরা এই অপশক্তিকেও শুভাশুভের অন্তরায় বলে চিহ্ণিত করতে পারি।

বেঁচে থাকার অর্থ এই সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অবিরাম ডাক দিয়ে যাওয়া। যারা বলে বেঁচে থাকার অর্থ কোনো অনির্দিষ্ট ইশারার প্রতি কেবলই নিঃশর্ত সমর্পণ, কেউ যদি বলে বেঁচে থাকার অপর নাম শুধুই মাথা গুঁজে উটপাখির মতো জীবন চালনা করা , কেউ যদি মনে করে মানুষের হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি নেই, কারও মতবাদ যদি সমাজকে ঠেলে দিতে চায় পেছনের দিকে, কোনো পক্ষ যদি মনে করে ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা কেবল তাদের জন্যই রক্ষিত রয়েছে—অন্য কেউ এর ভাগীদার নয়, কারও যদি মনে হয়—আমার মতবাদই উৎকৃষ্ট, বাকিদের মতামত বর্জ্যবস্তু, তাহলে ধরে নিতে হবে অবশ্যই এই শক্তিগুলি মানবসমাজের মুক্তিকামিতার ঘোর পরিপন্থী। প্রকৃতির চরিত্র এই পরাধীনতা থেকে নিজেকে স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ করা। অন্য প্রাকৃতিক বস্তুগুলি যেভাবে স্বাধীনতা ভোগ করে, মানবসমাজও তার হকদার। মানুষ নিজের তৈরি পরাধীনতার শৃঙ্খল নিজেই পরে নেয়, এই পরিণতি কোনো অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে না। বেঁচে থাকা এজন্যে যে, আমি নিজের পাশাপাশি পরের জন্য ভাবি। পর এলো কোথা থেকে! আমি যদি তাকাই আমার পূর্বতন তিনপুরুষের দিকে, তাহলে দেখব, সেখানে আমাদের পরিবারের একজন মাত্র পুরুষ। তাঁর সঙ্গে যখন মিলিত হলেন তাঁর স্ত্রী, তখন তাঁরা দুই থেকে তিন চার হলেন। তাঁর দুই সন্তান থেকে এল আবার চার কি ছয়। সেই ছয় থেকে একই প্রক্রিয়ায় এল বারো কি চোদ্দো। এই যদি মানব-বিকাশের ধারা হয়, তবে আমাদের প্রাচীন আরও প্রাচীন মনুষ্য সন্তান যিনি, তিনি যে আমার আপন—এটুকু জানতে ডারউইন কিংবা আদম-ইভের সাহায্য না-নিলেও চলে।

সুতরাং বলে দিতে হয় না, আমরা একই মানব-প্রজাতির সন্তান। তাহলে কিসের এই বিভাজন? কিসের এই মেরুকরণ! একজন মানুষ যেটুকু সময়কাল ধরে বাঁচে, তা ব্রহ্মাণ্ডের সময়ের প্রেক্ষিতে নিতান্তই কণিকাস্বরূপ এক ক্ষণ মাত্র। এই সামান্য জীবনে তার কত কী করবার রয়েছে। কত অসহায়ের মুখে তাকানো রয়েছে। কত নিরুপায়ের পাশে দাঁড়ানো রয়েছে। তা না করে আমরা কেবল ‘আমি’ নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে বাঁচি। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা নিয়ে বাঁচি। বিপুল বোঝা নিয়ে বাঁচি। বাঁচি আর ভাবতে প্রস্তুত থাকি—এ হল আমার পাপের বোঝা, এ হল আমার কৃতকর্মের ফল, এটি আমার জন্মের দোষ বা গ্রহের ফের। আসলে বেঁচে থাকা কেন, এই মীমাংসা যতদিন না কেউ স্পষ্টভাবে স্থির করতে পারছে, ততদিন তার ক্লেশ নিবারণের সাধ্য কারও নেই, থাকে না।

বেঁচে থাকার অপর প্রান্তে রয়েছে মৃত্য। ঠিক যেমনটি থাকে পরাধীনতা। মৃত্যর ভয়াবহতা দিয়ে যাঁরা জীবনকে মাপার কথা বলেন, তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন। মৃত্যুর কথা পরের বার। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘জানবার আর জানাবার মাথাব্যথা আছে বলেই তো মানুষ হতে পেরেছে মানুষ। না-হলে সে ল্যাজটা আরও উঁচু করে তুলে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত।’ মনে করি বেঁচে থাকার এও এক অবশ্যশর্ত। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বুলবুল আহমেদ

সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা, এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। --- রাম প্রসাদ সেন মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি –  মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

আবদুল হক

একজন গোবিন্দ দেব ও তাঁর নীরবতা দিবস গোবিন্দচন্দ্র দেব কেবল পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন না, জীবনযাপনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার মানুষ। নীরব ধ্যানী, নিবিষ্ট চিন্তক, নিভৃত সাধক। আমরা কেউ পুণ্যবাদী, কেউ পুঁজিবাদী। তিনি এ দুয়ের বাইরে গিয়ে, উর্ধে উঠে, হয়েছিলেন মানুষবাদী।

সত্যরঞ্জন বিশ্বাস

প্রেক্ষিত চড়কঃ মুসলিম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বর্ষশেষের উৎসব হিসাবে ‘ চড় ক ’ বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকোৎসব। গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবি মানুষেরাই চড়ক উৎসবের মূল হোতা। দরিদ্রদের এই মহোৎসবকে বসন্তোৎসব হিসাবেও গণ্য করা যায়।