সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সত্যরঞ্জন বিশ্বাস

প্রেক্ষিত চড়কঃ মুসলিম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ



বর্ষশেষের উৎসব হিসাবে চড়বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকোৎসব। গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবি মানুষেরাই চড়ক উৎসবের মূল হোতা। দরিদ্রদের এই মহোৎসবকে বসন্তোৎসব হিসাবেও গণ্য করা যায়।

কঠোর কৃচছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে শিব সাধনার এই উৎসব বাঙালির পাল-পার্বণের থেকে একটু ভিন্ন ধরণের। একদিকে গভীর নিষ্ঠা,অন্যদিকে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন এবং আধ্যাত্মবাদে প্রবল বিশ্বাস চড়ক পার্বণকে বিশুদ্ধ ধর্মাচরণমূলম অনুষ্ঠানের শিরোপা দান করেছে। আচার-আচরণে কোন প্রকার ত্রুটি ঘটলে ভক্ত সন্যাসীর প্রতি লৌকিক দেবতা শিবের ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়। সেই রুষ্টতার ফলস্বরুপ গাজুনে-সন্ন্যাসীশারীরিক ও মানষিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং সেই রোষ দৃষ্টির ফল ভোগ করতে হয় বংশপরমপরায়গতভাবে - লোকসমাজে এই বিশ্বাস আজও প্রবহমান।




চরকির দুই প্রান্তে দড়ির সঙ্গে বাঁধা বড়শিতে ঝুলে থাকা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের অধুনা-সভ্যতা-লালিত গাজুনে সন্ন্যাসীরা শিবের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে সমস্ত দৈহিক যন্ত্রণাকে নীরবে সহ্য করে থাকেন। টিটেনাস টক্সায়েড নয়,জঙ্গলের নিমুকীলতার শিকড় আর পাতা মুখে পুরে দিয়ে,মেরুদণ্ডের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বড়শি ফুটিয়ে দেওয়া হয়। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরপাক খাওয়ার পর চড়কি থেকে নামিয়ে,পিঠের বড়শি খুলে ভক্তকে খাইয়ে দেওয়া হয় আটি সহ একটি কচি আমের অর্ধাংশ। ব্যাস, চিকিৎসা এই পর্যন্তই। ধারালো অস্ত্র, বড় বড় বেল, সিয়াকুল, বাবলাকাঁটার ওপর কুড়ি-পঁচিশ ফুট ওপর থেকে সন্ন্যাসীরা লাফিয়ে পড়েন নির্দ্বিধায়। ঢাক-কাঁসির ছন্দে ছন্দে বাণফোঁড়া, আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেন ভক্তদের কাছে মামুলি ব্যাপার। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মাচরণে চড়ক অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ হওয়ায় অন্য ধর্মের মানুষ এর সংস্পর্শে আসেন না। কিন্তু চড়কের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে চড়ক ঘোরার বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে অন্বিত। বৌদ্ধদের ধর্মচক্রের সঙ্গে চরকি ঘোরার বিষয়টির যোগসূত্র খুঁজে দেখা যেতেই পারে। বুদ্ধদেব যখন প্রথম সারনাথে ধর্ম প্রচার করলেন তখন তিনি পাঁচজন শিষ্যকে ধর্মদেশনা দিলেন এক বিশেষ মুদ্রায় বসে। এই মুদ্রার নাম ধর্মচক্রপ্রবর্তন মুদ্রা। যে পাঁচজন শিষ্যকে ধর্মদেশনা দিয়ছিলেন তাদের নাম - কৌণ্ডিণণ, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম, আসসাজি ( সংস্কৃত ভাষায় - কৌণ্ডিল্য, বপ্র, ভদ্রেয়, মহানম, আশ্বজিৎ)। এ শিয্যদের তিনি বলেছিলেন, তারা যেন ধর্মচক্রকে ঘুরিয়ে নিয়ে চলে,ধর্মের চাকা যেন না থামে। এই ধর্মের চাকা ঘুরিয়ে যাওয়ার রীতি মহাযানী বৌদ্ধদের মদ্ধ্যে আজও রয়েছে। বিশেষ করে কিম্পুরুষবর্ষীয় (তিব্বতীয়) লামাবাদীদের মধ্যে এর প্রভাব আছে। ভুটান, তিব্বত, অরুণাচল, লাদাক, নেপাল, সিকিম, বাংলার দার্জিলিং-এর লামাবাদীরা বছরের শেষ দিনে এই চাকা ঘুরিয়ে দেন আর বলেন,ওং মনিপদ্মে হুং, ওং মনিপদ্মে হং - এই চাকা যেন না থামে। চড়কের চরকিও নতুন বছরের আগমনের প্রাক্কালে চাকার মত ঘুরে ঘুরে মানুষকে ধর্মাচরণে উদ্বুদ্ধ করে।

চড়ক বসন্তকালীন উৎসব। এদেশে বসন্তকালকেই এক সময় নববর্ষ হিসেবে ধরা হত। ভারতবর্ষের বাইরে বহু দেশেও এই রীতি প্রচলিত ছিল। চড়ক যেহেতু বসন্তে উদযাপিত হয়, তাই আমাদের দেশের অন্য দুএকটি বসন্তোৎসবের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বসন্তোৎসবের সাদৃশ্য একটু খুঁজে দেখা যাক। গবেষক উমাপদ নাথ তাঁর দোলের দোলাপ্রবন্ধে পারস্যের নববর্ষ সম্পর্কে বলেছেন,প্রাচীন পারস্যেও বসন্তারম্ভ থেকে বর্ষগণনা হতো এবং বর্ষ-বন্দনার অঙ্গরূপে দোল ও হোলির মত রঙ খেলা ও সাজার রেওয়াজ ছিল। এটা ছিল তাদের বর্ষবরণ
নববর্ষবরণ সব দেশেরই প্রবহমান সংস্কৃতির একটি বিশেষ অঙ্গ। প্রাচীনকালে ইরানে,জার্মানিতে আমাদের দোল উৎসবের মতো করে বর্ষবরণ করা হত।প্রাচীনকালে ইরানে বসন্তকালে নববর্ষের প্রারম্ভে এক ব্যক্তিকে সঙ সাজিয়ে তামাশা করা হোত। বিদায়ী পুরাতন বছরের প্রতীক হিসাবে তাকে গণ্য করা হোত। প্রাচীন জার্মানীতেও একটি উৎসব প্রচলিত ছিল। এখানকার অধিবাসীরা মুখে মুখোশ পরে ছদ্মবেশ ধারণ করে সর্বাংগে লাল ও কালো রঙে মাখামাখি হয়ে ছুটোছুটি করতো। মেও গগার্সইউরোপীয় কার্ণিভালনামক যে উৎসবের কথা লিখেছেন,তা ঠিক আমদের দোল উৎসবের মতো।২
প্রাচীনকালের বিভিন্ন উৎসবের পট-পরিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন ভাবে। ঘটেছে আঙ্গিক বদল। প্রাকৃতিক কারণ, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এইসব পরিবর্তন সমাজও অঙ্গিভূত করে নিয়েছে। অনিল চন্দ্র বসুবার দোলপ্রবন্ধে যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধির একটি উক্তি তুলে ধরে এ পরিবর্তনের প্রসংগটি সূদৃঢ় করেছেন। বিদ্যানিধির মতে -চৈত্র মাসের দোল, ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে এগিয়ে এসে হোলির সঙ্গে মিশে এক হয়ে গেছে।৩
যশোর জেলায় চড়ক উৎসবের আর এক নাম দেল। দেল এবং দোল দুটোই বসন্তের উৎসব।
এবার চড়কের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বিভিন্ন উৎসবের যোগসুত্র কেমন তার সুলুক সন্ধান করে দেখা যাক। সিংহলে টুক্কমুনামে একটি উৎসবের সঙ্গে আমাদের দেশের চড়কে পিঠে বড়শি ফুটিয়ে ঘোরার সাদৃশ্য আছে।সিংহলের টুক্কুম' নামে (Hook-Swing)একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই পিঠ ফোঁড়ের ও চড়ক-ওড়ার তুলনা করা যায়। এই সময় অংশগ্রহণকারীর গায়ে একটা মুরগি মেরে তার রক্ত দেওয়া হয়।৪
গ্রীস ও মিশরে গাজনের সম্পর্কে জানা গেছে-গ্রীস দেশের লিঙ্গরূপীবেকস দেবে'র গাজনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অনকের এদেশের অবস্থা হইত। চড়ক গাছের মত একটি গাছও ছিল। মিশরবাসীদের গাজনে আবার লিঙ্গদেব আসারসকে ৩৮০ কলসি দুধ দিয়ে স্নান করান হইত ও তাহার প্রতীককে লইয়া নগর ভ্রমণ করা হইত।৫


প্রচীন ইউরোপেমে পোলউৎসবকে বসন্তোৎসব বলা হত। বসন্তের পুষ্পদেবীফ্লোরার' পূজো দিয়েই সুচনা হত এ উৎসবের। আর শেষ হত একটি যুপকে ঘিরে গ্রামের সব স্ত্রী-পুরুষের সম্মিলিত নাচ-গানের মধ্য দিয়ে। এই যুপটি পোঁতা হত গ্রামের একটি নির্জন স্থানে। বসন্তদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এই যুপের পবিত্রতা রক্ষা করা হত সারা বছরই। তারা এই যুপকে বলতোবসন্ত যুপ'বামে পোল'‘Encyclopedia of Britannica'(vol.xvii,page-931)-তে এ সম্পর্কে যে তথ্য আছে তা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এই রকম -মধ্য ও টিউডর যুগের ইংল্যাণ্ডে 'মে দিবস' (১লা মে)ছিল বিশেষ একটি পবিত্র দিন। ভোর থেকেই শ্রেণি নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধ সকলে চলে যেত বনে বনে। আর রাশি রাশি ফুল পল্লব নিয়ে মিছিল করে ফিরে আসত। মিছিলের মধ্যভাগে রঙিন ফিতে আর ফুলের মালায় সাজানো মে-ধ্বজা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসত বাহকের দল। সাধারনত বার্চ কাঠের তৈরি এই মে-ধ্বজা ওই বিশেষ দিনটির জন্যিই খাড়া করা হত। কিন্তু লণ্ডন বা অন্যান্য বড় বড় শহরগুলিতে আরও মজবুত কাঠের তৈরি এই মে-ধ্বজা স্থায়ীভাবে বসানো থাকত। পিউরটানদের কাছে এগুলি ছিল চোখের বালি। ১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পার্লামেন্টের এক আইন বলে মে-ধ্বজা নিসিদ্ধ হলেও,রাজতন্ত্রের পুনরভ্যুদয়ের সাথে সাথে আবার এর প্রচলন হয়। লণ্ডন শহরে সর্বশেষ মে-ধ্বজা বসানো হয়েছিল ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে। এই ধ্বজাটি সিডার কাঠের তৈরি এবং ১৩৪ ফুট উঁচু ছিল। দ্বিতীয় জেমসের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং প্রধান নৌ-সেনাপতির উপস্থিতিতে বর্তমান সেন্ট মেরি গির্জা বা তৎসন্নিহিত কোন এক জায়গায় ১২ জন ইংরাজ নাবিক এটি বসিয়েছিলেন। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে এটিকে তুলে এসেক্সের ওয়ানষ্টিড পার্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে স্যার আইজাক নিউটন একটি বৃহৎ দূরবীন বসানোর জন্য অন্যতম খুঁটি হিসাবে এটি ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের চড়কগাছ পোঁতার সঙ্গে এর বেশ সাদৃশ্য রয়েছে।
আমদের দেশর বিভিন্ন প্রান্তে চড়কপূজোর প্রচলন আছে। কোথাও কোথাও শিবের সঙ্গে এ পূজো অন্বিত,আবার কোথাও কোথাও অন্যান্য দেবতার সঙ্গে এর সংযোগ দেখা যায়। যেমন দাক্ষিনাত্যের কোনও কোনও অঞ্চলে চড়ক পূজো প্রচলিত আছে। কিন্তু সেখানে শিবের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। দাক্ষিণাত্যের তামিলেরা এই উৎসবকে ঢেড্ডুকবলে।৬
মুসলিম ধর্মের সঙ্গেও চড়কের রয়েছে এক গভীর সাদৃশ্য। মুসলিম নবিদের কেচ্ছা আব্দুল ওহাব রচিতকাছা সালাম্বিয়'তে খলিলুল্লার বয়ানে এবংহজরত এব্রাহিমশিরোনামে যে কাহিনিটি বিবৃত হয়েছে তা থেকে জানা যায়, চকের প্রবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত মহম্মদের পূর্বপুরুষ হজরত ইব্রাহিমের নাম। মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত ধারেল শহরে ইব্রাহিম জন্মেছিলেন আনুমানিক চার হাজার বছর আগে। তার পিতার নাম আজর। ইব্রাহিমের পিতা ধর্মে ছিলেন পৌত্তলিক আর কর্মে কুম্ভকার। দেবমূর্তি নির্মান করেই চলত তার জীবন-জীবিকা। কিন্তু ইব্রাহিমের এই জড়ধর্ম ভালো লাগল না। তিনি পৈত্রিক ধর্মকে অস্বীকার করে নিরাকার একেশ্বরবাদী অর্থাৎ তৌহিদ হয়ে উঠলেন। আজর বহু চেষ্টা করেও পুত্রকে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে না পেরে তাকে গৃহছাড়া করে দিলেন। শুধু গৃহছাড়া করেই আজর খান্ত হলেন না, রাজা নমরুদের কাছে ধর্মদ্রোহী ইব্রাহিমকে ধরিয়ে দিলেন। নমরুদ সব বিত্তান্ত শুনে মন্ত্রিকে নির্দেশ দিলেন ইব্রাহিমকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করতে। মন্ত্রী লোক-লস্কর নিয়ে ধরে বেঁধে ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করলেন অগ্নিকুণ্ডে। কিন্তু আগুন ইব্রাহিমের শরীর স্পর্শ করল না। যেহেতু তিনি আল্লাহর নবি তাই তাঁকে পুঁড়িয়ে মারার ক্ষমতা কারো নেই। কেচ্ছাতে ছড়ার ছন্দে বিষয়টিকে লেখা হয়েছে এইভাবে --
এক হাজার সাত সত নয় বছরেতে।
পয়দা হৈলেন নহ নবির তুফান বাদেতে।
... না পায় দেখিতে আর না পারে চলিতে।
হামেহাল থাকে তারা ঠাকুর ঘরেতে।।
হজরত (ইব্রাহিম) শুনে কন সবাকে তখন।
লড়িতে চড়িতে নাহি পারে জেই জোন।।
না পারে কহিতে কথা না পায় দেখিতে।
তারে খোদা ভেবে পূজা করো কি জন্যেতে।।
এই কথা শুনে তারা হেট করে মাথা।
কেহবা কহিল ঠিক বলেছ এ কথা।।
... এবরাহিমে মারিবারে করিল ফিকির।
ছলা করে ঠিক করে এই ছাই তদরির।।
... বলিল তাহারা সবে নবিকে ধরিয়া।
আগুনে ডালিয়া ওরে দেহ জ্বালাইয়া।।
তারপর হজরত ইব্রাহিমের জন্য চতুর্দিকে বারো ক্রোশ ব্যাসার্ধ করে মস্ত বড় এক অগ্নিকুণ্ড জ্বালানো হল, যার লেলিহান শিখা একশো গজ উচু হয়ে জ্বলতে লাগল। নমরুদের আদেশে যারা এই অগ্নি প্রজ্বলন-কার্যে নিরত ছিল তারা সকলে মিলে রাজার কাছে দরবার করল। রাজাকে বলল,আমরা তো আগুনের কাছেই যেতে পারি না,তাহলে ইব্রাহিমকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করবো কি করে'? রাজা নমরুদ তখন ডেকে পাঠালেন শয়তান শিরোমণি ইবলিছ মলউনকে। ইবলিছ বিধান দিলেন --
কহিল চড়ক গাছ তৈয়ার করিয়া।
উচা জায়গার পরে, রাখগো আনিয়া।।
শয়তানের কাছে তারা তামিল হইয়া।
সেতাবি চড়ক গাছ নিল বানাইয়া।।
এর আগে দুনিয়াতে কেহ দেখে নাই।
মঞ্জেনিক আরবিতে কহেন সবাই।।
চড়ক গাছ কহে তারে বাঙ্গালা জবানে।
দেখেছিল দোজাখেতে ইবলিশ শয়তানে।।

বাদশা নমরুদের আদেশে এবং ইবলিছের পরামর্শে ইব্রাহিমকে পুড়িয়ে মারার জন্যই তৈরি হল চড়ক গাছ। আরবি ভাষার মঞ্জেনিক, আর বাংলাভাষার চড়ক গাছকে, দুনিয়ার মানুষ সেই প্রথম দেখল।
তারপর নবি ইব্রাহিমকে জোর করে ধরে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হল এবং হাজার খানেক লোক মিলে চড়ক গাছকে হেলানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হল। তখন ইবলিছ চড়ক গাছের মাথায় চরকির মতো একটি আঁড়কাঠি সংস্থাপন করে তার দুই প্রান্তে দুটি রশি (দড়ি) বেঁধে দিলেন। তার একটি রশিতে ইব্রাহিমকে বেঁধে দেওয়া হল। আর অন্য রশিতে জনা চল্লিশ মিলে দিলেন টান। ইব্রাহিম অনেক উঁচুতে উঠে ছিটকে গিয়ে পড়লেন জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। সঙ্গে সঙ্গে খোদার হুকুমে দুই ফেরেস্তা এসে নিভিয়ে দিলেন আগুন। আর সেই নির্বাপিত অগ্নিকুণ্ড থেকে উত্থিত হলেন ইব্রাহিম। তাঁর গায়ে আগুনের এতটুকু আঁচ লগে নি। কিন্তু নমরুদের পোষাক-পরিচ্ছদ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। পরে বেহেস্ত থেকে জিবারিল এসে ইব্রাহিমকে নমরুদের তখতে বসিয়ে রাজপোষাক পরিয়ে দিলেন আর মাথায় পরিয়ে দিলেন বেহেস্তের তাজ। এদিকে ইব্রাহিমকে মারার জন্য অগ্নিকুণ্ড তৈরি করতে যে রাশি রাশি কাঠ সঞ্চিত হয়েছিল, দেখতে দেখতে সেগুলি সব ফুল হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ নমরুদ বড় বড় পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল ইব্রাহিমের দিকে। আর পাথরগুলি সব মিলিয়ে যেতে লাগল শূন্যে।
আরব দেশে যে পৌত্তলিকতা প্রচলিত ছিল ইতিহাসও তার সাক্ষ্য বহন করে। ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী তাঁরমধ্যযুগের ইতিহাসগ্রন্থে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,মহম্মদের পূর্বে আরবগণ,ইহুদি,খ্রিষ্টান,অগ্নি উপাসক অথবা প্রকৃতি-পূজক ছিল। আবার কেউবা ছিল পৌত্তলিক। মহম্মদ কোরায়েশ বংশের সন্তান। এই বংশীয়গণ বহু দেবতার পূজা করিত। তারা পৌত্তলিক ছিল। সেই সমস্ত দেবতার মধ্যে আল্লাহ,হুবাল,লাত মনাত,উজ্জা ইত্যাদি দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দেবতাদের মধ্যে আল্লা ছিলেন প্রাধান। প্রত্যেক পরিবারেই বাস্তুদেবতা থাকিত। কোন যুদ্ধ-বিগ্রহে,লুণ্ঠনে যাত্রার পূর্বে আরবগণ বাস্তুদেবতার পূজা করিত। পৌত্তলিকতা থেকে আরব দেশকে মুক্ত করার এবং একেশ্বরবাদ বা নিরাকারবাদের প্রবর্তক হিসাবে হজরত মহম্মদর নাম শোনা গেলেও, বিদ্রোহী নবি ইব্রাহিমই এর মূলচ্ছেদ করেন। যে প্রক্রিয়ায় ইব্রহিমকে মারার চেষ্টা হয়েছিল তার নামচড়ক'। আরবি ভাষায়মঞ্জেনিক'। এই ইব্রাহিমের বংশেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিশ্বনবি হজরত মহম্মদের জন্ম।
ইব্রাহিমই যে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রথম সোচ্চার হয়েছিলেন এবং তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে মারার চেষ্টা হয়েছিল, পবিত্র কোরাণে তার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মাওলানা মোবারক করিম জওহর সাহেবের অনুদিত পবিত্র কোরাণ শরীফের ৭ম পারার ৭৪ আয়াতে বলা হয়েছে -স্মরণ কর ইব্রাহিম তার পিতা আজরকে বলেছিল - আপনি কি মূর্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেন? আমি তো আপনার ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখছি।৭
সপ্তদশ পারার ৬৮ আয়াতে আছে,...ওরা বলল তবে ওকে (ইব্রাহিমকে)পুড়িয়ে দাও। তোমাদের দেবতাগুলিকে সাহায্য কর, তোমার যদি করতে চাও। ৬৯ আয়াতেআমি বললম, হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। ৭০ আয়াতওরা ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে এক ফন্দি আঁটতে চাইল,কিন্তু আমি ওদের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।৮
হজরত মহম্মদের জন্ম ও বংশতালিকা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে,তার বংশের প্রথম পুরুষের নাম আদম, ২০তম পুরুষ ইব্রাহিম,নব্বইতম পুরুষ মহম্মদ। ইব্রাহিম মহম্মদের উর্ধতন ৭০তম পুরুষ। প্রত্যেক পুরুষ ৩০ বছর হিসাবে ধরলেও মহম্মদের সময়কাল (ষষ্ট শতাব্দী)থেকে মোটামুটি ২,১০০ বছর পূর্বে ইব্রাহিমকে পাওয়া গেছে। তাহলে বোঝা যায়,বহু শতাব্দী আগে থেকে চড়ক বা মঞ্জেনিক-এর উৎপত্তির ইতিহাস জড়িয়ে আছে একজন যুগ প্রবর্তকের নামের সঙ্গে।৯
হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থে বিবৃত ভক্ত প্রহ্লাদের কাহিনীর সঙ্গে ইব্রাহিমের কাহিনির যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। আবার গাজনে সন্যাসীদের বাণফোঁড়া, বড়শি ফোঁড়া, আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে ইব্রাহিমকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলা, তাঁর দিকে পাথর নিক্ষেপের কাহিনির সাযুজ্য আছে। উভয় ক্ষেত্রেই কৃচ্ছ্রসাধনের দ্বারা উপাস্য দেবতার আশিস প্রাপ্ত হয়ে ভক্ত বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও অক্ষত রয়ে যায়। আবার এই কৃচ্ছ্রসাধনের মূল নিহিত আছে জৈনধর্মের মধ্যে। ফলে হিন্দুদের চড়কের সঙ্গে মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষঙ্গের যোগ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কারণ,বাহ্যিক আচরণে বৈপরিত্য থাকলেও সব ধর্মের মূলকথা একই। সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য যদি এ কাহিনির সৃষ্টি হয়ে থাকে,তাহলেও মন্দ কী?
চক্রের দ্বারা অশুভ শক্তি নাশের বিষয়টি আমাদের শাস্ত্রে স্বীকৃত। অসুর বিনাশের সঙ্গে নারায়ণের সুদর্শন চক্রের সম্পর্ক গভীরভাবে অন্বিত। আলোচিত প্রবন্ধে নববর্ষ বরণের উৎসবগুলির মদ্ধ্যে চক্রাকারে ঘোরার বিষয়টি দিয়ে অশুভ শক্তি বিনাশের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধদের ধর্মচক্র,খ্রিষ্টানদেরমে পোল' উৎসবে যুপকাষ্টকে ঘিরে আবর্তন, মঞ্জেনিক দ্বারা ইব্রাহিমকে বিনাশের প্রচেষ্টা, হিন্দুদের চড়ক - সব বিষয়ের সঙ্গে চক্রাকারে ঘোরা এবং সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে একটা শুভ সময়ের আগমন সূচিত করার প্রায়াস দেখা যায়। চড়কের চরকি ঘোরার সঙ্গে কিছু কিছু ধর্মীয় উৎসবের এই সাদৃশ্য সম্প্রীতিরই দ্যোতক বলেই মনে হয়।

মূল সহায়ক গ্রন্থঃ
লোকসংস্কৃতিঃ প্রেক্ষিত দেল বা চড়ক-গাজন - ডঃ সত্যরঞ্জন বিশ্বাস, ২০০৯, রুবি পাবলিকেশন, কলকাতা - ৯।
তথ্যসূত্রঃ
১। দোলর দোলা - উমাপদ নাথ, দৈনিক বসুমতী, ২ চৈত্র, ১৩৮২
২। প্রাচীন উৎসব দোল - সঞ্জিত কুমার মুখোপাধ্যায়, দৈনিক বসুমতী, ২ চৈত্র, ১৩৮২
৩। বার দোল - অনিল চন্দ্র বসু, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ চৈত্র, ১৩৮০
৪। চড়ক - বুদ্ধদেব চৌধুরী, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ চৈত্র, ১৩৮০। প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগৃহিত হয়েছে - Hook-Swing, Mysore quarterly journal of the Myhic society II (1911), Page 57-58; J.H.Powell, ‘Hook-Swing in India’Folk-Lore XXV (1914), Page 141-197
৫। শিবের গাজন ও চড়ক পার্বণ - কালিদাস দত্ত, বন্ধু, ১ম বর্ষ, ২৬ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৪
৬। বিশ্বকোষ - নগেন্দ্র বসু, ১৩০২ ৬ষ্ঠ ভাগ, পৃষ্ঠা- ৮১
৭। কোরাণ শরীফ - মৌলনা মোবারক করীম জওহর, পৃষ্ঠা - ৯৪
৮। কোরাণ শরীফ - মৌলনা মোবারক করীম জওহর, ১৯৭৪, পৃষ্ঠা - ৯৪ এবং ২০৮
৯। *এই হিসাব - সীরাৎ-ই-রসুল্লুল্লাহ সৈয়দ আহম্মদ প্রণীত ‘Essay on Muhammad and Islam’ গ্রন্থ অবলম্বনে কৃত এবং গোলাম মোস্তাফা প্রণীত বিশ্বনবি গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বুলবুল আহমেদ

সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা, এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। --- রাম প্রসাদ সেন মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি –  মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

আবদুল হক

একজন গোবিন্দ দেব ও তাঁর নীরবতা দিবস গোবিন্দচন্দ্র দেব কেবল পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন না, জীবনযাপনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার মানুষ। নীরব ধ্যানী, নিবিষ্ট চিন্তক, নিভৃত সাধক। আমরা কেউ পুণ্যবাদী, কেউ পুঁজিবাদী। তিনি এ দুয়ের বাইরে গিয়ে, উর্ধে উঠে, হয়েছিলেন মানুষবাদী।